২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রবল ওই ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে গ্রাম পর গ্রাম লণ্ডভণ্ড ও বালেশ্বরসহ নদীর তীরে বাঁধগুলো ধসে পড়ে। তবে সিডরের একযুগ পার হলেও স্থানীয়দের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে বালেশ্বর নদীর তীরে এখনও একটি টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি।
বিধ্বংসী ওই ঘূর্ণিঝড়ের দুঃস্বপ্নের স্মৃতি এখনও উপকূলীয় বাসিন্দাদের তাড়া করে। বিশেষ করে শরণখোলা উপজেলার যারা প্রিয়জনদের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের সর্বস্ব হারিয়েছেন তাদের। ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাস বালেশ্বর নদীর তীরে বাঁধ ভেঙে উপকূলীয় অঞ্চলে গ্রামের পরে গ্রাম ডুবে যায়।
২০১৬ সালে বাগেরহাটের সদর, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও রামপাল উপজেলায় খুলনা জেলার সদর, শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ ও রামপাল উপজেলায় ৬২ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য ৬৯৬ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল।
শরণখোলার বলেশ্বর নদী পাড়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চার বছর আগে শুরু হওয়া বাঁধের কাজ এখনও শেষ হয়নি। প্রায় ৭০ ভাগ কাজ হয়ে গেছে এবং কাজটি শেষ হতে আরও এক বছর সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে বর্ধিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
এতো বছর ধরে গাবতলা থেকে বোগী পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার প্রবাহ নদীতে গিয়েছিল এবং আরও কিছু পয়েন্ট শিগগিরই যেকোন সময় নদীর তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। গাবতালা থেকে বগী পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন সময় ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে আরও কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ বিষয়ে বাঁধ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শ্যামল কুমার দত্ত বলেন, ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।
বাগেরহাটের শরণখোলা এবং মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় নদী পাড়ে ৬২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করার কথা ছিল। কিন্তু ১০ কিলোমিটার এলাকায় এলজিইডির রাস্তা থাকায় এখন ৫২ কিলোমিটার বাঁধ করা হচ্ছে।
তার দেয়া তথ্য মতে, বেড়িবাঁধটি টেকসই ও আর্ন্তজাতিক মানের নির্মাণ করা হচ্ছে।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প ফেইজ-১ (সিইআইপি-১) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম জানান, ইতিমধ্যে ৪০ কিলোমিটার বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। পাঁচ কিলোমিটারের কাজ চলছে। রায়েন্দা ও বগী এলাকায় সাত কিলোমিটার বাঁধের কাজ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বগী এলাকায় বাঁধ নির্মাণে ছয় একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ হলে বগী এলাকায় কাজ শুরু করা হবে। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ৬৯৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে।
তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত গেট নির্মাণ ও মেরামত, নদীভাঙন রোধসহ ছোট-ছোট নদী-খাল খনন করা হবে।
বাগেরহাট জল উন্নয়ন বোর্ডের (ডাব্লুডিবি) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান জানিয়েছেন, তারা বাঁশকে টেকসই করতে বালেশ্বর নদীকে প্রশিক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছেন।
বাগেরহাট জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ-জ্জামান জানান, শরণখোলায় বলেশ্বর নদী পাড়ের বাঁধ স্থায়ী করতে নদী শাসন করার জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে।
বগী অঞ্চল পরিদর্শন করে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোঃ মামুনুর রশিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন বিপর্যয়ের কারণে এখানকার মানুষ ঘন ঘন দুর্ভোগ পোহায়।
বগী এলাকা পরিদর্শন শেষে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, এই এলাকার বেশকিছু মানুষ এখনও দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়। যেকোনো ঝড়-জলোচ্ছাস এলেই তাদের ঝুঁকিতে থাকতে হয়।
বগী গ্রামের বাবুল হাওলাদার বলেন, ১০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সময় স্ত্রী-সন্তানদের আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে একাই ঘরে ছিলেন। বাঁধ উপচে জোয়ারের পানিতে ঘর তলিয়ে যায়। এসময় তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে একটি গাছ ধরে বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার দুই বিঘা জমি বালেশ্বর নদীতে চলে গেছে। শুধু ঘরটুকু বাকি আছে। তার ঘর বাইরে রেখেই নতুন বাঁধের জায়গা নির্ধারণ করায় হতাশায় পড়েছেন তিনি।
গাবতলা আশর আলো মসজিদ-ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল বারেক হাওলাদার জানান, বালেশ্বর নদী এখন এটি গ্রাস করার জন্য মসজিদে এসে পৌঁছেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি টেকসই বাঁধটি নির্মিত না হলে, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়টিও নদীতে যাবে।
গাবতলা আশার আলো মসজিদ কাম সাইক্লোন শেল্টারের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. বারেক হাওলাদার জানান, নদী ভাঙতে ভাঙতে এখন প্রায় মসজিদের কাছে এসে গেছে। এখনই টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হলে নদী পাড়ের মানুষের দুর্যোগের এই আশ্রয়স্থলও বিলীন হয়ে যাবে।
মো. মোজাম্মেল হোসেন, দক্ষিণখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, তিনি জানান, তাঁর ইউনিয়নের বাসিন্দারা ঘন ঘন নদীর জমি ও জমি হারাচ্ছেন।
ছয় নম্বর বগী ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য মো. রিয়াদুল পঞ্চায়েত ও দক্ষিণ সাউথখালী ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. জাকির হাওলাদার জানান, এই ইউনিয়নবাসী প্রতিবছর দুই-তিনবার ঝড়-বন্যার মোকাবেলা করতে হয়। প্রতিবছর নদীভাঙনে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঝুঁকিপূর্ণ এই এলাকাতে টেকসই বাঁধ নির্মাণে কোনো উদ্যোগ নেই।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডর উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানে। এতে প্রায় ৯০৮ জন নিহত ও ৭৬ জন নিখোঁজ হন। প্রায় ১ হাজার ৬২৭ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল ধ্বংস হয় এবং ৬৫ হাজার ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।